ফ্যাক্ট চেক: ‘বিজেপি ক্ষমতায় এলে মুসলিমদের ভোটাধিকার নয়!' হিমন্ত কি এমন মন্তব্য করেছেন?

সুরাজউদ্দিন মণ্ডল: আজ থেকে শুরু হয়ে গেছে লোকসভা নির্বাচন। দেশের ১০২টি আসনে অনুষ্ঠিত হবে ভোটগ্রহণ। প্রথম দফার নির্বাচনে ২১টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করবেন শাসক-বিরোধী সব শিবিরের প্রার্থীরা। এবারে দিল্লির ক্ষমতা কার দখলে থাকবে তা প্রথম দফায় ভোট দানের মাধ্যমে নির্ধারণ করবেন বাংলার তিনটি আসন, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ির বাসিন্দারাও। 

তবে এরই মধ্যে সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে নির্বাচনে জয় ও ক্ষমতা দখল সংক্রান্ত একটি বিশেষ পোস্ট। যেখানে ‘দৈনিক যুগশঙ্খ’ পত্রিকার প্রতিবেদনের একটি কাটিং শেয়ার করা হয়েছে। অসমের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মার ছবি সহ ওই প্রতিবেদনের হেডলাইনে লেখা হয়েছে, “বিজেপি ক্ষমতায় এলে মুসলিমদের ভোটাধিকার নয়: হিমন্ত।” ছবিটি শেয়ার করে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মা ঘোষণা করেছেন যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হবে।

উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ছবিটি শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখেছেন, “#ভয়ঙ্কর_টার্গেট। অসমের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা।” 

একই ছবি পোস্ট করে অপর এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “যে জাতি অতীত ভুলে যায়, সেই জাতির ধ্বংস অনিবার্য! যেই বিজেপি সময়ে মুসলমানদের অপমান, নির্যাতন, উচ্ছেদ, করে আসছে, সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে সেই বিজেপির হয়ে যেসব মুসলমান গলা ফাটাচ্ছেন এদের নিয়ে কোন শব্দ বলার মতো নেই! এদের ধ্বংস অনিবার্য!”

ছবিটি শেয়ার করে অপর একজন লিখেছেন, “বিজেপি শুধু মুসলিম নয় বরং পুরো দেশের জন্য ক্ষতিকর। মূল্য বৃদ্ধি থেকে, বেকারত্ব, জাতপাতের লড়াই থেকে নিয়ে দেশের সম্পদ কে বেসরকারি করণ সবক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর। সুতরাং বিজেপি কে হারাতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী দল গুলোকে জেতাতে হবে।” (সব ক্যাপশনের বানান অপরিবর্তিত।) এমনই একটি পোস্টের আর্কাইভ এখানে দেখা যাবে।

ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল প্রতিবেদনের দাবিটি অর্ধসত্য ও বিভ্রান্তিকর। হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মার মন্তব্যকে এখানে বিকৃত করে বিভ্রান্তি ছড়াতে প্রচার করা হচ্ছে। 

কীভাবে জানা গেল সত্য?

ভাইরাল প্রতিবেদনটি ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেটি ২০১৬ সালের ১২ মার্চ ‘দৈনিক যুগশঙ্খ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সূত্র ধরে আমরা খোঁজার চেষ্টা করি এই সংক্রান্ত পোস্ট সবার প্রথম কবে শেয়ার করা হয়েছিল। তখন আমরা দেখতে পাই ২০১৬ সালের ১২ মার্চ তারিখেই এক ফেসবুক ব্যবহারকারীও একই দাবিতে একটি পোস্ট করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, “হিমন্ত বাবু আপনি বলেছেন বিজেপি ক্ষমতায় এলে মুসলিমদের ভোটাধিকার থাকবে না। এদেশে রাম রাজত্ব করতে গেলে সংবিধান বদলাতে হবে, যা সম্ভব নয়। আমি আপানাদের চ্যালেঞ্জ করছি আমাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিন। আপনি বা সর্বা কে বলছি এটা কারো বাবার হিম্মত হবে না কোন ভারতীয়কে বাংলাদেশ পাঠানো।ভোটের জন্য যা তা কিছু বলবেন না। এদেশে আপনারা বাংলাদেশি। কিন্তু আমরা এদেশে আছি এদেশে থাকবই।” (ক্যাপশনের সব বানান অপরিবর্তিত।)

যদিও আমরা আমাদের সার্চে ‘দৈনিক যুগশঙ্খ’ পত্রিকার ২০১৬ সালের ১২ মার্চের সংস্করণটি খুঁজে পাইনি। তবে উপরে উক্ত ফেসবুক ব্যবহারকারীর পোস্টের কমেন্ট সেকশনে ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ তারিখে ভাইরাল প্রতিবেদনের একটি অংশ কমেন্ট হিসাবে দেখতে পাই। মন্তব্যকারী প্রতিবেদনটিকে সরাসরি বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেছেন।

এরপর এই সংক্রান্ত আরও বিস্তারিত তথ্য পেতে সাল তারিখ-সহ আমরা বিভিন্ন কিওয়ার্ড সার্চ করি। তখন ২০১৬ সালের ১১ মার্চ আমরা সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই। সেখানে ২০১৬-র অসম বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচারের দায়িত্বে থাকা হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, অসম বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হলে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার আগে পর্যন্ত সে দেশ থেকে ভারতে আসা মুসলিমদের ভোটা দেওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে। তারা ভারতে থাকবে পারবে, তবে সেক্ষেত্রে তাদের পুনরায় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। 

ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ভাইরাল প্রতিবেদনের সারাংশতেও রয়টার্সের প্রকাশিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেই সারাংশতে লেখা হয়েছে, “১৯৫১-৭১-এর মধ্যে আসা সংখ্যালঘুরা অনুপ্রবেশকারী। ব্যক্তিগত আবেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনও মুসলিম যদি এ দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন সেটা ব্যতিক্রম।”

এরপর এই একই বিষয় নিয়ে ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে দেওয়া হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মার একটি সাক্ষাৎকার খুঁজে পাই। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, “আমাদের লড়াই অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমদের সঙ্গে। অসম, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মুসলিমদের সঙ্গে নয়। তাই ১৯৫১-১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অসম তথা ভারতে আসা মুসলিমদের এদেশে থাকতে হলে পুনরায় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। তবে ১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমদের কোনও নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।” 

পাশাপাশি ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মার এক্স হ্যান্ডেলেও একটি পোস্ট দেখতে পাই। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, “এ দেশের আদি মুসলিমদের নিয়ে আমরা ভালো আছি। কিন্তু যে সমস্ত মুসলিমরা অবৈধভাবে ভারত তথা অসমে বসবাস করছে তারা আমাদের সংস্কৃতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

এর থেকেই প্রমাণ হয় যে, বিজেপি ক্ষমতায় এলে মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হবে এই ধরনের কোনও মন্তব্য করেননি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মা। বরং তাঁর মন্তব্য দাবি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে প্রতিবেদনটি ভাইরাল করা হচ্ছে সেটি বিভ্রান্তিকর ও অর্ধসত্য। প্রথমত, যে সময়ে হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মা এহেন মন্তব্য করেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে তখন তিনি অসমের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। তখন অসমে কংগ্রেসের শাসন ছিল। আর সেই সরকারে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তরুণ গগৈ। আর সেই সময় হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মা ছিলেন অসম বিজেপির প্রচারের মুখ। দ্বিতীয়ত, তিনি বলেছিলেন অসম বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হলে ১৯৫১-১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ভারত তথা অসমে আসা মুসলিমদের ভোটারাধিকার বাতিল করা হবে। সমস্ত মুসলিমদের ভোটাধিকার নয়। 

2024-04-19T06:30:10Z dg43tfdfdgfd