মোদীর মুখে মোদী নেই

প্রশান্ত ভট্টাচার্য

মোদীর মুখে 'মোদী' নেই! শুক্রবার সংসদের সেন্ট্রাল হলে নরেন্দ্র মোদী ১ ঘণ্টা ১২ মিনিটের ভাষণ দেন। এই ভাষণ জুড়ে ৩৯ বার তাঁর মুখে এনডিএ স্তুতি শোনা গেল। একটিবারও প্রধানমন্ত্রীর মুখে 'মোদীর গ্যারান্টি', 'মোদী' সরকার বা 'মোদী'র কোনো প্রশংসার কথা শোনা গেল না। শুধু তাই নয়, মোদীর মুখে আবার জোট বন্দনা। এনডিএ-র নেতা নির্বাচিত হয়ে শরিক দলগুলোকে ধন্যবাদ জানান নরেন্দ্র মোদী শুক্রবারই নবনির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে বৈঠকে বসে এনডিএ।

সেখানেই সর্বসম্মতিতে নেতা নির্বাচিত হয়েছেন মোদী। শেষ পর্যন্ত সফল হতে পেরে মোদী বলেন, 'সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার কাছে অত্যন্ত খুশির বিষয় যে সকলকে স্বাগত জানানোর সুযোগ পেয়েছি।' তাঁর দাবি, এনডিএ-র মতো কোনো শক্তিশালী জোট আজ পর্যন্ত দেশে হয়নি। দেশবাসী জানে, আমরা হারিনি, ভবিষ্যতেও হারব না। এনডিএ জোট দেশ সেবার প্রতি সমর্পিত। ক্ষমতার লালায়িত নয়। মোদী বলেন, 'সরকার চালাতে প্রয়োজন হয় বহুমতের। দেশ চালাতে প্রয়োজন হয় সর্বমতের।'

এনডিএ'র প্রশংসা করে তিনি বলেন, অন্যান্য জোট পাঁচ বছরের জন্য হয়। কিন্তু আমাদের জোট ৩০ বছরের। ৩ বার আমরা সরকার চালিয়েছি। চতুর্থবারে পা রাখছি। এনডিএ শুধু কয়েকটি দলের জোট নয়, এটা দেশের প্রতি দায়বদ্ধ মতবাদের সমুহ শক্তির জয়।' এখানেও লক্ষ্য করার, মোদী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারের কথা টেনে আনলেন, যা বহুদিন তাঁর মুখে শোনা যায়নি।

মাতৃগর্ভে জন্ম হয়নি দাবি করে যে মোদী কয়েকদিন আগে নিজেকে 'স্বয়ম্ভু' সাজাতে চেয়েছিলেন, গত ১০ বছনের শাসনকালে যে মোদী নিজেকে রাজনীতিতেও 'স্বয়ম্ভু' প্রতিপন্ন করে তুলেছিলেন, এবার এক ঝটকায় ২৪০-এ নেমে আসতে সেই মোদীর মুখে শুধুই এনডিএ। অথচ সাম্প্রতিক অতীতের বাস্তব হল এটা, মোদীর দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম চার বছরে সেই জোটের কোনও বৈঠকই হয়নি!

গত বছরের ১৮ জুলাই বেঙ্গালুরুতে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র আনুষ্ঠানিক আবির্ভাবের দিনে দিল্লিতে এনডিএর শরিকদের নিয়ে প্রথম বৈঠক করেছিলেন মোদী, অমিত শাহ, জেপি নাড্ডারা। গত পাঁচ বছরে এনডিএর সেটিই প্রথম এবং সেটিই শেষ বৈঠক! তার পর এই শুক্রবার নতুন সঙ্গী চন্দ্রবাবু নায়ডুর টিডিপিকে নিয়ে বারবার এনডিএর ঐক্যের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করলেন মোদী।

কংগ্রেসকে নিশানা করে মোদী দাবি করেন, এবারের ভোটে যত সংখ্যক আসনে বিজেপি জিতেছে কংগ্রেস গত ৩টি লোকসভায় সবমিলিয়ে তার ধারে কাছে পৌঁছোতে পারেনি। আগামী এক দশকে কংগ্রেস ১০০ আসনও পাবে না। কথা হচ্ছে এনডিএ নিয়ে, সেখানেও কংগ্রেসকে ডেকে আনা কেন? আসলে ৪০০ পার বা এককভাবে ৩৭০ না হতে, মোদী এক্কেবারে এমন জব্দ হয়েছেন, যে কংগ্রেসকে তিনি ও তাঁর দল লুপ্তপ্রায় বলে ধরে নিয়েছিলেন, তাকেই স্মরণ করতে হচ্ছে জোট বাঁচিয়ে রাখার ন্যারেটিভ তৈরি করতে।

তবে মানতেই হবে কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রকের ৪৫ ঘণ্টা ধ্যান-তপস্যা কাজ দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে, অন্তত কণ্ঠে 'ত্যাগ' শুনতে পাওয়া যাচ্ছে,। গত দেড় মাস ধরে যে মোদী সভা-সমিতিতে কথায় কথায় ‘মোদী সরকার’, ‘মোদীর গ্যারান্টি’র বাণী শোনাতেন, শুক্রবার সেই মোদী এনডিএর বৈঠকে টানা এক ঘণ্টা ১২ মিনিট ভাষণ দিলেন অথচ একটি বারও মুখে আনলেন না নিজের নাম! বদলে ৩৯ বার বললেন এনডিএ।

এমনকী, একবারও উচ্চারণ করলেন না বিজেপির নাম। লোকসভা ভোটের প্রচারে কাশ্মীর থেকে কাকদ্বীপ, কচ্ছ থেকে কাছাড়, যেখানে গিয়ে ভাষণ দিয়েছেন, সেথানেই নিজের 'শ্রীমুখ' থেকে 'মোদী গ্যারান্টি', মোদী সরকার' উচারণ করেছেন। রাজ্যে রাজ্যে গিয়ে ‘মোদীর গ্যারান্টি’র বিজ্ঞাপন করছিলেন। সংবাদমাধ্যমের বিজ্ঞাপনে 'মোদী গ্যারান্টি'। যে কোনও সভায় তাঁর সরকার কী কী কাজ করেছে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বারবার উচ্চারণ করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন 'মোদী সরকার'এর কথা।

মোদীর প্রতিটি সভার পোস্টারে-প্ল্যাকার্ডে-ফেস্টুনে চোখে পড়ার মতো বড় হরফে লেখা থাকত 'মোদী সরকার', 'মোদী গ্যারান্টির' কথা। মোদীর বক্তৃতাতেও ঘুরে ফিরে আসত ‘মোদী কি গ্যারান্টি’র প্রসঙ্গ। এমনকী, একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে লোকসভা ভোটের প্রচার পর্বে মোদী তাঁর নামোচ্চারণ করেছেন ৪২১ বার। সেই মোদীর শুক্রবারের বক্তৃতা 'মোদী-হীন'! তবে ৭২ মিনিটের ভাষণে একবার গ্যারান্টির কথা বলেছেন। এক বার। তবে তার আগে-পিছে কোথাও 'মোদী' লবজটা লাগাননি।

এ কী রত্নাকরের বাল্মিকী রূপান্তর! তাও বা বলি কী করে! মোদীর ভাষণে তো 'রাম'ও উধাও। এসেছে 'জগন্নাথ'। তবে শুক্রবারই প্রথম নয়, ৪ জুন ভোটের ফলে যখন এনডিএ ম্যাজিক ফিগার টপকায়, তখন ‘জয় জগন্নাথ’ দিয়ে মঙ্গলবার বক্তৃতা শুরু করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেদিন মোদীর ৩৪ মিনিটের বক্তৃতায় এক বারও ‘জয় শ্রীরাম’ শোনা যায়নি। সেদিন রামমন্দিরের কথা বললেন যদিও, কিন্তু বিজেপি নয়, জোর দেন এনডিএ নামক জোটের ওপর।

সেদিনও তাঁর ভাষণে বার বার শোনা যায় এনডিএ-র কথা। এখন কথা হল, তাঁর ভাষণে ‘জয় শ্রীরাম’ নেই, তাঁর বক্তৃতায় ‘মোদী সরকার’ নেই, তাঁর বক্তৃতায় ‘গ্যারান্টি’ নেই। তাঁর বক্তৃতায় ‘বিজেপি’ও নেই। তা হলে আছে কী?

বুধবার ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লি যাওয়ার পথে কলকাতা বিমানবন্দরে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মোদীকে তীব্র কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, 'যে রামমন্দিরকে আপনি অ্যাজেন্ডা বানিয়ে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর প্রতিটি মানুষের কাছে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন রামমন্দির আমি বানিয়েছি এবং বিজেপি রামের প্রতিষ্ঠা করেছে। আচ্ছা ভগবানের প্রতিষ্ঠা কী করে একজন মানুষ করতে পারেন? কেউ কি করতে পারে? আমার মধ্যে কি ক্ষমতা আছে যে আমি ভগবানের প্রতিষ্ঠা করব? এটাই দেখা গিয়েছে, যেখানে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেখানেই বিজেপি হেরে গিয়েছে। আমি শুধু বলব, প্রভু রাম এসেছে সেকারণে বিচার এসেছে।'

সেই মতি ফিরে এসেছে বলেই বোধহয় মোদীর ভাষণে 'মোদী' উধাও। আর মোদীর মুখে 'জয় জগন্নাথ' নিয়ে সোশাল মিডিয়ার চালু ভাষ্য, 'জগন্নাথ জোটের দেবতা। কেন না, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা সবসময় জোটবদ্ধভাবে থাকেন।' রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছেন, রবিবার মোদী তৃতীয়বারের জন্য শপথ নেবেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। তবে অবশ্যই এনডিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু এবারে মোদীর হাতে জাদুসংখ্যা ২৭২ থেকে ৩২টা কম, ফলে জোট সঙ্গীদের মন রক্ষা করেই চলতে হবে।

আর এখানেই হতে পারে সমস্যা। আত্ম অহংকারে পূর্ণ মানুষটি গত ১০ বছর নিজের ইচ্ছেমতো সরকার ও দেশ চালনা করেছেন, তিনি কি পারবেন আগামী পাঁচ বছর জোট সঙ্গীদের যথাযথ সম্মান দিয়ে জোটধর্ম পালন করতে? এখন তাই গ্যারান্টির বদলে এটা চ্যালেঞ্জ। বন্ধুরা বলছেন, 'জগন্নাথ' তাঁর সহায় হোন।

(লেখকের নিজস্ব মতামতে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন, এর দায়ভার 'এই সময় ডিজিটাল' বহন করে না।)

এই ধরনের আরও খবর জানতে এই সময়ে আসুন। লেটেস্ট নিউজ, শহরের তাজা খবর, দেশের খবর, ব্যবসার খবর, খেলার আপডেট, দৈনিক রাশিফল এবং লাইফস্টাইলের টিপস জানুন। আর ভিডিয়োর জন্য রয়েছে TimesXP

2024-06-08T05:56:05Z dg43tfdfdgfd