বিখ্যাত পরিবারের ছেলে মুখতার আনসারি যেভাবে গ্যাংস্টার হয়ে ওঠেন

উত্তরপ্রদেশের জেলে বন্দী অবস্থায় গ্যাংস্টার মুখতার আনসারির মৃত্যুর পরে সেরাজ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মি. আনসারি বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। তার পরিবার অভিযোগ করছে দীর্ঘ সময় ধরে জেলে বিষ খাওয়ানো হয়েছিল তাকে।

সংবাদ সংস্থা পিটিআই বলছে মি. আনসারির নিজের জেলা মৌ ছাড়াও আলিগড়, ফিরোজাবাদ, প্রয়াগরাজ, কাসগঞ্জ-সহ রাজ্যের একাধিক জেলায় আধাসামরিক বাহিনীর সঙ্গে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছে পুলিশ।

গাজীপুরে তার বাসভবনের বাইরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, সেখানে রাত থেকে হাজির হয়েছেন তার প্রচুর সমর্থক।

মঙ্গলবার তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে জেল থেকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করে আইসিইউতে রাখা হয়।

সেখানেই বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান বলে মেডিক্যাল বুলেটিনে জানানো হয়েছে।

তার পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে ম্যাজিস্টেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে উত্তর প্রদেশ পুলিশ। তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল গড়া হয়েছে। তার দেহের ময়না তদন্ত করবেন দুজন চিকিৎসক, এমনটাও জানিয়েছে প্রশাসন।

খুন, চাঁদাবাজি সহ ৬৫টি মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে, যার মধ্যে আছে ১৪টি খুনের মামলা। তার নামে যেসব খুনের মামলা আছে, তার মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড তিনি ঘটিয়েছিলেন বিজেপির বিধায়ক কৃষ্ণানন্দ রাইকে খুন করার সময়ে।

ওই ঘটনায় ৫০০ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল মি. আনসারি ও তার সঙ্গীরা।

তবে উত্তর প্রদেশ আর পাঞ্জাবের বিভিন্ন জেলে ২০০৫ সাল থেকে বন্দী থেকেছেন তিনি। জেল থেকেই তার সাম্রাজ্য চালিয়ে গেছেন বলে জানা যায়।

কম বয়সেই অপরাধে হাতেখড়ি

কুখ্যাত এই গ্যাংস্টারের অপরাধ জীবনের শুরু মাত্র ১৫ বছর বয়সে। তার জন্মস্থান গাজীপুরের অন্তর্গত সৈয়দপুর থানায় ঢুকে হুমকি দিয়েছিলেন পুলিশ কর্মীদের।

সেই ঘটনাতেই প্রথম মামলা দায়ের হয় তার নামে।

এর পরে বিভিন্ন গ্যাংস্টারের সঙ্গে কাজ করলেও নিজে বড় ধরণের অপরাধ করতে শুরু করেন ১৯৮৮ সাল থেকে।

প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাংস্টারদের হত্যা, ঠিকাদারদের অপহরণ করে হত্যা বা মুক্তিপণ আদায় করা, ঠিকাদারির কাজ জোর করে হাতিয়ে নেওয়া – সব অপরাধেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন মি. আনসারি।

আবার অপরাধ জগতে নিজের ক্ষমতা বাড়াতে যোগ দিয়েছিলেন রাজনীতিতে।

বন্দী অবস্থাতেই বারে বারে ভোটেও জিতেছেন। পাঁচ বার ভোটে জিতে বিধানসভার সদস্য হয়েছিলেন তিনি।

বিখ্যাত পরিবারের সন্তান

বিবিসিতে প্রচারিত একটি পুরনো প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু তিনি নন, তার পুরো পরিবারই রাজনীতিতে যুক্ত চার পুরুষ ধরে।

মি. আনসারির পরবর্তী প্রজন্মও রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। তার পুত্রও দুবছর আগে বিধানসভা সদস্য হয়েছেন ভোটে জিতে।

আবার তার এক সম্পর্কিত চাচা হামিদ আনসারি ছিলেন ভারতের উপরাষ্ট্রপতি।

তার দাদা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী মুখতার আহমেদ আনসারি। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ভক্ত মি. আনসারি গত শতাব্দীর কুড়ির দশকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পরে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির উপাচার্যও হয়েছিলেন তিনি।

আবার মুখতার আনসারির মায়ের বাবা সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মুহম্মদ উসমান ১৯৪৮ সালে ভারত শাসিত কাশ্মীরে পাকিস্তানী হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন।

মুখতার আনসারির বাবা সুবহানুল্লাহ আনসারির একটা পরিষ্কার ভাবমূর্তি ছিল গাজীপুর এলাকায়। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন স্থানীয়ভাবে।

কৃষ্ণানন্দ রাই হত্যাকাণ্ডে ৫০০ গুলি চলে

গাজিপুরের মুহম্মদাবাদ বিধানসভা আসন ১৯৮৫ সাল থেকেই আনসারি পরিবারের দখলে ছিল। তবে ১৭ বছর পর ২০০২ সালের নির্বাচনে বিজেপির কৃষ্ণানন্দ রাই সেই আসনে জিতে যান।

তিন বছর পর তাঁকে হত্যা করা হয়।

প্রবীণ সাংবাদিক পবন সিং, যিনি পূর্বাঞ্চলে এই গণহত্যার খবর কভার করেছিলেন, তিনি বিবিসিকে বলছিলেন যে "মি. রাই একটি অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে ফিরছিলেন যখন তার বুলেট প্রুফ টাটা সুমো গাড়িটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয় এবং নির্বিচারে গুলি চলতে থাকে। হামলার জন্য এমন একটি রাস্তা বেছে নেওয়া হয়েছিল যেখান থেকে গাড়িটি ডাইনে বা বাঁয়ে ঘোরানোর সুযোগ ছিল না। কৃষ্ণানন্দের সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন আরও ছয় জন। একে-৪৭ থেকে প্রায় ৫০০ গুলি ছোড়া হয়, সাতজনই নিহত হন।“

কৃষ্ণানন্দ রাইয়ের স্ত্রী অলকা রাই সংবাদ সংস্থা এএনআইকে শুক্রবার বলেছেন, “এটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ। আমরা তার কাছে সবসময়ে ন্যায় বিচার চেয়ে প্রার্থনা করে গেছি। আজ বিচার হল। ওই ঘটনার (তার স্বামীর হত্যাকান্ড) পর থেকে আমরা কখনও হোলি উদযাপন করি নি। মনে হচ্ছে আজই আমাদের হোলি।“

লাইট মেশিন গানও ছিল তার

বহু ধরণের অস্ত্রের মধ্যে মুখতার আনসারির একটি লাইট মেশিন গানও ছিল। সেটা পুলিশ উদ্ধার করেছিল ২০০৪ সালে।

সেই অস্ত্র উদ্ধারকারী পুলিশ দলের নেতা ছিলেন শৈলেন্দ্র সিং নামে এক ডেপুটি পুলিশ সুপার।

মি. আনসারি মারা যাওয়ার পরে শুক্রবার মি. সিং সংবাদ সংস্থা এএনআইকে একটি সাক্ষাতকার দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “২০ বছর আগে, ২০০৪ সালে মুখতার আনসারির সাম্রাজ্য তখন তুঙ্গে। সে হুড খোলা জিপে চেপে ঘুরে বেড়াত। দাঙ্গার মধ্যেও ওই ভাবে ঘোরাঘুরি করত। সেই সময়েই আমি একটা লাইট মেশিন গান উদ্ধার করি তার কাছ থেকে।“

“তার আগে বা পরে কখনও লাইট মেশিন গান উত্তরপ্রদেশে কখনও উদ্ধার হয় নি। আমি তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দিয়েছিলাম। তবে আমাকে পনের দিনের মধ্যেই ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়। আমি পদত্যাগ পত্রে অবশ্য সত্য কথাটা লিখে এসেছিলাম। মানুষের জানা উচিত যে কেন আমি পদত্যাগ করছি,” বলেছেন মি. সিং।

যোগী আদিত্যনাথের ওপরে হামলা

উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ওপরে একবার হামলা চালিয়েছিল মুখতার আনসারির দল।

মৌ জেলায় ২০০৫ সালে দাঙ্গার মধ্যেই মি. আদিত্যনাথের গাড়ি বহরের ওপরে হামলা। হয়। স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন ওই ঘটনাই মি. আনসারির অপরাধ এবং রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে শুরু করে। ওই হামলার পরেই ধীরে ধীরে উত্তর প্রদেশে তার প্রভাব কমতে শুরু করে।

একের পর এক মামলায় তার জেল হতে থাকে।

আর যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মুখতার আনসারি ভয় পেয়ে যায় যে তাকে উত্তরপ্রদেশের জেলে রাখা হলে মেরে ফেলা হতে পারে।

তাই তাকে পাঞ্জাবের রোপার জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।

বিপুল সম্পত্তি

উত্তর প্রদেশ পুলিশ গতবছর জুন মাসে ৬৬ জন গ্যাংস্টারের একটি তালিকা প্রকাশ করে, সেখানেও নাম ছিল মুখতার আনসারির।

পুলিশ জানিয়েছিল যে তার দলের ২৮৮ জন সদস্যর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, ১৫৫টি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।

পুলিশ এও জানিয়েছিল যে ৫৮৬ কোটি ভারতীয় টাকা মূল্যের সম্পত্তি তারা বাজেয়াপ্ত করেছে এবং ২১০০ কোটি ভারতীয় টাকার যে বেআইনি ব্যবসা ছিল তার, সেটা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া গেছে।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন

বিবিসি বাংলায় অন্যান্য খবর

2024-03-29T12:57:36Z dg43tfdfdgfd