রাজনীতির মাঠে যেভাবে খেলছেন ইউসুফ পাঠান

উইকেটের সামনে স্টান্স নিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। প্রথম বল লেগের দিকে তুলে মারলেন। সোজা ছক্কা। কিন্তু পরের দুইটি বল ফসকালেন। তারপর আবার ব্যাটে বলে হলো, বল মাটি ঘেঁষে চলে গেল বাউন্ডারি সীমানার বাইরে। মুর্শিদাবাদের আমতলার কাছে মহম্মদপুরের আল আমিন মিশনের মাঠে এটাই হলো তৃণমূল প্রার্থী ইউসুফ পাঠানের ব্যাট হাতে মাঠে নেমে পড়ার কাহিনি। দুই বলে ১০ রান যেমন করেছেন, তেমনই দুটি বল ফসকেছেন।

এটা ছিল তার চেনা ২২ গজের পিচের কাহিনি। যে পিচে তিনি ক্রিকেট জীবনে অনেক চার-ছয়ের বন্যা বইয়েছেন। কিন্তু রাজনীতির অনভ্যস্ত পিচে কেমন খেলবেন ইউসুফ, প্রশ্নটা এখানেই। তার রাজনৈতিক শত্রু অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে হারাতে বদ্ধপরিকর মমতা এবার মোদী-শাহের রাজ্য গুজরাট থেকে উড়িয়ে এনে ইউসুফকে নামিয়ে দিয়েছেন এক অজানা পিচে। তিনি না জানেন এই রাজ্যকে, না বোঝেন এখানকার ভাষা, এখানকার সংস্কৃতি, মানুষের মন-মনন সম্পর্কে তার খুব বেশি ধারণা থাকার কথা নয়। রাজনীতি সম্পর্কে তো নয়ই। এখন তিনি দলের নেতা ও ভোট-কুশলীদের শেখানো বুলি আউড়ে যাচ্ছেন, এই ৪৩-৪৪ ডিগ্রি গরমে মুর্শিদাবাদের গ্রাম-গঞ্জে সভা করছেন, রোড শো করছেন। আর তাকে দেখার জন্য প্রচুর মানুষ জড়ো হচ্ছেন। প্রচুর তরুণদের ভিড় হচ্ছে। ছবি তোলা ও সেলফির জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যাচ্ছে। যেমন হলো মহম্মদপুরেও।

সেখানে ক্যাম্বিস বলে একটা ১৪ ওভারের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হচ্ছিল। নাম এমপিএল। সেখানেই এলেন ইউসুফ। তিনি আসতেই তার পিছনে পিছনে ধেয়ে এলো ভিড়। তিনি যেখানে গেলেন, ভিড়ও চললো। উন্মাদনা দেখা গেল। ইউসুফ হাসিমুখে ঘুরলেন। ছবি তুললেন, কিঞ্চিত খেলা দেখলেন। মাইকে কথা বলতে চাইছিলেন না। পরে দলের নেতাদের পীড়াপিড়িতে রাজি হলেন। বললেন, জিতলে মুর্শিদাবাদে স্পোর্টস একাদেমি খুলবেন। তাতে শুধু ক্রিকেট নয়, সব ধরনের খেলা শেখার ব্যবস্থা থাকবে। বিস্তর হাততালি পড়লো।

তারপর গাড়িতে উঠে চলে গেলেন ইউসুফ জনসভা করতে। ইউসুফ চলে যাওয়ার পর স্বভাবিকভাবেই বিচ্ছিন্ন কিছু জটলা তৈরি হলো। সেখানে আলোচনা হতে থাকলো, ইউসুফ কি জিতবেন? মুহম্মদপুর মুসলিম প্রধান গ্রাম। বস্তুত, বহরমপুর আসনটিই মুসলিম প্রধান। এখানে ৬৪ শতাংশ ভোটদাতাই মুসলিম। গত পাঁচটি লোকসভা নির্বাচনে এখান থেকে জিতেছেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী। দীর্ঘদিন ধরে বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে। মুসলিম ভোটের সিংহভাগ তার কাছেই গেছে। এবার কি ইউসুফ সেখানে বড় ভাঙন ধরাতে পারবেন?

২০১১ সালের পর থেকে বহরমপুরেও বিশাল পরিবর্তন এসেছে। বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে সাতটি বিধানসভা আসন আছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে সাতটির মধ্যে ছয়টি পেয়েছে তৃণমূল এবং একটি বিজেপি। পুরসভাও তৃণমূলের হাতে। পঞ্চায়েতেও তাদের সংখ্যাধিক্য। ফলে অধীর-দুর্গের পতনের জন্য একটি মাত্র কাজ করতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেটা হলো, খোদ অধীরকে হারানো। সেজন্যই ইউসুফ পাঠানকে উড়িয়ে আনা। অন্য কেউ হলে একবাক্যে বলে দেয়া যেত, অধীরের রাজনৈতিক বাউন্সারের সামনে টিকতে পারবেন না তিনি। কিন্তু ইউসুফ পাঠানকে ঘিরে যে ক্রেজ তৈহি হচ্ছে, তা যদি ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হয়?

ইউসুফ চলে যাওয়ার একটু পরেই মহম্মদপুরের একটি জটলায় একজনের দাবি, ইউসুফ অন্তত ৫৫ হাজার ভোটে জিতবেন। পরে জানা গেল, তিনি তৃণমূল সমর্থক। তার সামনেই সিপিএম নুরুল বললেন, এখানে তো মানুষ এসেছিলেন ইউসুফকে দেখতে। ওরা কি ভোট দেবে নাকি? এবার সিপিএম কর্মীরাও চেগে গেছেন। তারা ভয় কাটিয়ে বাইরে এসেছেন। জোটের পক্ষে প্রচার করছেন। এবং ভোটটা তারা অধীরকেই দেবেন। সিপিএম কর্মীরা যে উজ্জীবীত হয়ে প্রচারে নেমেছেন, তা মুর্শিদাবাদে দেখেছি, বহরমপুরেও তা টের পেয়েছি। নুরুলের দাবি, মুসলিম ভোট ভাগ হবে। ইউসুফ তার তিরিশ শতাংশের বেশি পাবেন না। জটলার প্রায়. সকলেই একটা বিষয়ে একমত হলেন, যারা ইউসুফকে দেখতে ভিড় করেছিলেন, তারা সকলেই যে তাকে ভোট দেবেন এমন নয়। কিন্তু তারা একথাও বলছেন, মুসলিম ভোচ ভাগ হবেই। সিংহভাগ ভোট কার দিকে যাবে, সেটাই প্রশ্ন।

ভোটের অংক বড় জটিল। তার মধ্যে অনেক হিসাব থাকে, অনেক যদি-কিন্তু থাকে। সবচেয়ে বেশি থাকে মানুষের একটা ধারণা, যে ধারণা অনেক হিসাব বদলে দেয়। সেই ধারণা বদল করতেই তিনদিন ধরে মুর্শিদাবাদে এসে বসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জনসভা করেছেন। অধীর-গড়ে বসে তাকে হারানোর রণকৌশল ঠিক করে দিয়েছেন তিনি।

ডিডাব্লিউকে অধীর বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী মেরুকরণ করতে চাইছেন। তিনি ইমামদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।

ইউসুফের সঙ্গে মমতা আছেন, অভিষেক আছেন, ভোট-কুশলীরা আছেন, তার নিজের ক্যারিশমা আছে। আবার গুজরাট থেকে উড়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়া নিয়ে সমালোচনা আছে। মমতা যে মুসলিম ভোট কেটে অধীরের যাত্রাভঙ্গ করতে চাইছেন, মানুষের মনে সেই ধারণাও আছে। আর আছে এনআরসি-সিএএ নিয়ে ভয়। এই এত সব বিষয় নিয়েই তো এখানে খেলা হবে।

এরই মধ্যে এক সরকারি আধিকারিক এক অন্য অংকের কথা শোনালেন। তার বক্তব্য, তিন প্রার্থীই ৩০ শতাংশ করে ভোট পাবে। ১০ শতাংশ ভোটের সিংহভাগ যিনি টানতে পারবেন, তিনিই জিতবেন। ফলে টি-টোয়েন্টির শেষ ওভারের মতো খেলা হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

জিততে পারুন বা হেরে যান, ইউসুফ পাঠান বহরমপুরের ভোটে আলাদা উত্তেজনা নিয়ে এসেছেন। ভোটের মাঠের সেই উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে।

প্রতিবেদন: গৌতম হোড় (মুর্শিদাবাদ), স্যমন্তক ঘোষ (মুর্শিদাবাদ)

2024-04-29T23:44:39Z dg43tfdfdgfd