সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরছেই, যেন দেখার কেউ নেই

এবারের ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অর্থাৎ ৪ঠা এপ্রিল থেকে ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় তিনশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৩৫০ জন। আহত হয়েছেন ১৩শ জনেরও বেশি।

বেসরকারি সংস্থা যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে এই তথ্য উঠে এসেছে। এসব দুর্ঘটনার বেশিরভাগই ঘটেছে মহাসড়কে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফরিদপুরের কানাইপুরে বাস ও পিক-আপের ধাক্কায় ১৫ জন নিহতের ঘটনা।

এছাড়া ঝালকাঠির গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় একটি সিমেন্টবাহী ট্রাক কয়েকটি গাড়িকে পিষে দেয়ায় ১৪ জন নিহতের ঘটনাও সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টিকে সামনে এসেছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, ঈদ বা বড় কোনো উৎসবে ছুটির সময় মহাসড়ক ধরে বিভিন্ন জেলায় মানুষের চলাচল বেড়ে যায়। তখন এ ধরণের দুর্ঘটনার খবর বেশি পাওয়া যায়।

গত এক দশকে মহাসড়কে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও সে তুলনায় নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি।

এর পেছনে চালকদের বেপরোয়া ও অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালানো, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, আইনের প্রয়োগের অভাবসহ বছরের পর বছর এই খাতে পাঁচটি মূল সমস্যাকে দায়ী করছেন সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

মহাসড়কে হালকা যান

বাংলাদেশের মহাসড়কে যাত্রী পরিবহনে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ইজি-বাইক, নসিমন-করিমন, ভটভটির মতো বহুমাত্রিক যানবাহন চলাচল করে।

এমনকি পণ্যবাহী গাড়িতেও যাত্রী তোলা হচ্ছে অহরহ যা উৎসবের সময় আরও বেড়ে যায়।

মহাসড়কে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, অবৈধভাবে চলাচলকারী এসব যানবাহনের চলাচল দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ঈদের সময় দূরপাল্লার পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার কারণে স্বল্প আয়ের মানুষেরা বাড়ি যেতে এই ঝুঁকিপূর্ণ বিকল্প পরিবহনগুলো বেছে নেন।

অথচ এ ধরণের নিষিদ্ধ ও অবৈধ যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএর নিজস্ব কোনো জনশক্তি নেই। এই দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশের হলেও এ নিয়ে তাদের তৎপরতা নিয়েও আছে প্রশ্ন।

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কিভাবে মহাসড়কে স্বল্পগতির এসব যানবাহন চলাচল করছে এমন প্রশ্নের জবাবে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শাহবুদ্দিন খান বলেছেন, সড়ককে ব্যবস্থাপনায় আনার দায়িত্ব শুধু হাইওয়ে পুলিশের নয়।

এক্ষেত্রে আরও যেসব অংশীদার আছে তাদের সাথে সমন্বয় করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে তিনি জানান।

বুয়েটের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্যাটারিচালিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। বিআরটিএ আইনে মহাসড়কে এ ধরণের ধীরগতির যানবাহন চলা নিষিদ্ধ। মহাসড়কে থ্রি-হুইলার নিষিদ্ধে ২০১৪ ও ২০১৭ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনা দেয়।

সড়ক বিভাগ ২০১৫ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মহাসড়কে এ ধরণের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও অনুমোদন ছাড়াই মহাসড়কে চলছে।

নগর-মহানগরগুলোতে ট্রাফিক বিভাগ এগুলো দেখভাল করলেও আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কে কেউ তাদের জিজ্ঞাসা করে বলে মনে হয় না।

এছাড়া মহাসড়কের দুই পাশে হাটবাজার বসিয়ে অনেকটা পরিকল্পিতভাবেই এই হালকা যান চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে বলে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন।

তবে স্বল্প আয়ের মানুষদের চলাচলের ক্ষেত্রে এই থ্রি হুইলারগুলো সহজলভ্য ও অল্প ভাড়ার বাহন হয়ে ওঠায় এগুলো পুরোপুরি উঠিয়ে দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না।

এক্ষেত্রে প্রতিটি মহাসড়কের পাশে সার্ভিস রোড নির্মাণের ওপর জোর দিয়েছেন সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। এরিমধ্যে কয়েকটি মহাসড়কে সার্ভিস রোড তৈরি হয়েছে।

তবে অভিযোগ উঠেছে স্বল্পগতির যানবাহন অনেক সময় সার্ভিস রোড ছেড়ে দ্রুত চলার জন্য মহাসড়কে উঠে আসে।

মহাসড়কের সঙ্গে গ্রামীণ সড়ককে সংযুক্ত করে দেয়ার ফলেও দ্রুত ও কম গতির যানবাহনের সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।

অন্যদিকে যেসব মহাসড়কে সার্ভিস রোড নেই সেখানে ভারী যানের চালকরা প্রায়ই সড়কের বাস্তবতা না বুঝে অসংবেদনশীল হয়ে পড়ে এবং হামলা যানগুলোতে চাপা দেয় বলে জানিয়েছেন বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মো. মাহবুব আলম তালুকদার।

ফিটনেসবিহীন মোটর যান

বিআরটিএ-এর তথ্যমতে বাংলাদেশে ২০টি ক্যাটাগরির নিবন্ধিত মোটরচালিত যানের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখের মতো। এরমধ্যে ৪৪ লাখ বাহনই মোটরসাইকেল। বাকি ১৬ লাখের মধ্যে প্রায় ছয় লাখ যানবাহনের কোন ফিটনেস নেই।

বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা সংস্থাকে ‘ম্যানেজ’ করে এই যানগুলো চলছে বলে জানিয়েছে যাত্রীদের অধিকারে কাজ করা সংস্থাগুলো।

ঈদ-যাত্রার সুযোগে বেশিরভাগ ফিটনেসবিহীন বাস মহাসড়কে উঠে পড়ে যা ঈদে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়ার আরেকটি বড় কারণ।

কেননা সড়কে যতো দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে দুর্ঘটনাকবলিত যানটির ফিটনেস নেই। ফরিদপুর ও ঝালকাঠির ঘটনা এর বড় উদাহরণ।

সড়কে চলাচলের জন্য যেকোনো যানবাহনের যান্ত্রিক ও কাঠামোগত ফিটনেস থাকতে হয়। কাঠামোগত দিকটি চোখে দেখে দেওয়া গেলেও যান্ত্রিক দিক পুরোপুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়।

পুরো প্রক্রিয়াটি দেখভাল করার মতো প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও পদ্ধতিগত সক্ষমতার অভাব যেমন আছে তেমনি লোকবল সংকটও রয়েছে।

এদিকে সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান মহাসড়কে দুর্ঘটনার পেছনে হাইওয়ে পুলিশের তদারকিতে ঘাটতিকে চিহ্নিত করেছেন।

তিনি বলেন, “ফরিদপুরের ঘটনা তো দিনে দুপুরে রয়েছে। মহাসড়কে পণ্যবাহী পিক-আপে যাত্রীরা চলাচল করলো কেউ কিছু বলল না, কোন তদারকি নেই। ফিটনেসবিহীন গাড়ি কমছে তো না-ই বরং বাড়ছে। এখন ভারী যানের মালিকরা বিআরটিএ থেকে ফিটনেস সনদ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা মনে করছেন না।”

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আইন প্রয়োগে প্রশাসনের দুর্বলতা যেমন আছে তেমনি তারা ও দুর্নীতি করে অবৈধ সুযোগ নিয়েই এসব যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছে।

বিআরটিএর অনেক পরিদর্শকের বিরুদ্ধে গাড়ি না দেখেই অর্থের বিনিময়ে ফিটনেস সনদ দেওয়ার এমনকি গাড়ি পুলিশের হেফাজতে আটক থাকাকালেও ফিটনেস সনদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এক্ষেত্রে যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা ও লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি বেসরকারিকরণের ওপর জোর দিয়েছেন বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের অধ্যাপক মো. মাহবুব আলম তালুকদার।

ফিটনেসবিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে বিআরটিএ প্রায়ই অভিযান চালায়। অভিযান চলাকালে কিছুদিন এগুলো রাস্তায় বের হয় না। পরে আবার যথারীতি চলতে শুরু করে।

বুধবার ঝালকাঠিতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পর জানা যায়, চালকের নিবন্ধন ছিল হালকা শ্রেণির, ট্রাক চালানোর অনুমতিই ছিল না

এছাড়া দুর্ঘটনা কবলিত ট্রাকটি ২০১২ সালের এক্সেল লোড নীতিমালা অনুযায়ী, ১৩ টন পণ্য পরিবহনে সক্ষম।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে ২০ টন ওজনের চারশো বস্তা সিমেন্ট তোলা হয়েছে। নিয়ম অমান্য করে ট্রাকটি খুলনা থেকে বিনা বাধায় গাবখান পর্যন্ত চলে।

অথচ সড়ক পরিবহন আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী, অতিরিক্ত ওজন বহন দণ্ডনীয় অপরাধ।

তার আগে ফরিদপুরে দুর্ঘটনায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পণ্যবাহী পিক-আপে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছিল। নিহত সবাই ছিলেন পিক-আপের চালক বা যাত্রী। বাসটির রুট পারমিট যথাযথ ছিল না।

বেপরোয়া গতি

বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাসড়কে দুর্ঘটনার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ গতিসীমা মেনে না চলা।

এ ব্যাপারে সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেছেন, “যানবাহনের গতি বাড়ানোর জন্য সড়ক প্রশস্ত করা হচ্ছে, লেন বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু যান চলাচলের ব্যবস্থাপনায় কোন শৃঙ্খলা নেই। হালকা যানগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। এদিকে গতি তারতম্যে মহাসড়কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।”

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, মহাসড়কগুলো উন্নত করার কারণে চালকদের মধ্যে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু এই গতি নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর কোন স্মার্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

সেইসাথে বাংলাদেশে যানবাহনের চালকদের সাইড দেওয়ার সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেনি। বেশি গতিসম্পন্ন যানবাহনকে অনেকটা জোর করেই ওভারটেক করতে হয়।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণাতে দেখা গেছে, মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তার বড় কারণ বেপরোয়াভাবে বা অতিরিক্ত গতিতে চালানোর প্রতিযোগিতা এবং বিপজ্জনক ওভারটেকিং।

ঈদের দিন থেকে পরের কয়েক দিন সড়ক ফাঁকা থাকায় এ সুযোগে পাল্লাপাল্লি করে গাড়ি ওভারটেক করেন চালকরা।

সড়ক পরিবহন বিধিমালার ১২৫-এ গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও কীভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা হবে, তা বলা নেই।

অতিরিক্ত পণ্য বহনের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকায় নির্মিত সড়ক-মহাসড়ক টিকছে না। খানাখন্দ সৃষ্টি হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। ফরিদপুরের দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, সড়কের গর্তে চাকা আটকে বাসটি আড়াআড়ি হয়ে গিয়েছিল। সেখানে পিকআপ ধাক্কা লেগে ওই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ডিভাইডার বিহীন রাস্তাগুলোতে হয়েছে। বাংলাদেশের চালকদের আচরণ বিবেচনায় নিয়ে সব রাস্তায় ডিভাইডার বসানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অদক্ষ ও ক্লান্ত চালক

বাংলাদেশের মহাসড়কে চলার উপযোগী যানগুলোর চালক নিয়োগ পদ্ধতি বেশ ক্রুটিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

গণপরিবহন চলাচলে বাড়তি চাপ থাকায় অনেক সময় মৌসুমি চালকরা এমনকি চালকের সহকারীরা দূরপাল্লার গাড়ি চালায়।

মি. চৌধুরী বলেন “বেশিরভাগ চালকই একসময় হেলপার ছিল। তারা ওস্তাদের কাছ থেকে শিখে বড় যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাকের চালক হয়েছে। তাদের যথাযথ কারিগরি জ্ঞান নাই। এজন্য মহাসড়কে কোন দুর্ঘটনার পরিস্থিতি হলে তারা সেটা সামাল দিতে পারে না।”

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, বাংলাদেশকে পরিবহনকে এখনও শিল্পের মর্যাদা দেয়া হয়নি। এ কারণে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, কর্মঘণ্টা ও বেতন ভাতা নির্ধারণ হয়নি।

এ কারণে দেখা যায়, চালকরা উৎসবের সময় ট্রিপভিত্তিক কাজ করেন। ভিত্তিক। অর্থাৎ একজন চালক যতো ট্রিপ দেবেন সে হিসেবে টাকা পাবেন। এবং অতিরিক্ত মুনাফার আশায় তারা দিনরাত বিরামহীন কাজ করেন।

অনেকে ক্লান্ত হয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালান, অনেক সময় ঘুমিয়ে পড়ার ফলে সড়কে সংঘর্ষের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

মালিকরাও চেষ্টা করে, কত কম খরচ করে, পরিবহন শ্রমিকদের বেশি খাটিয়ে বেশি লাভ করা যায়। ফলে তারা বাসের ফিটনেস, চালকদের সক্ষমতার দিকে নজর দেন না।

এবারে তিন শতাধিক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতি দেখেছে যে এর বেশিরভাগই মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে হয়েছে। চালক ঘুমিয়ে পড়ার কারণে এমনটা হয়েছে বলে তারা চিহ্নিত করেছেন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, চালকদের অনেকের সড়কের চিহ্ন এবং আইন কানুন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। এমনকি অনেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও থাকে না।

আবার যাদের লাইসেন্স থাকে তাদের দক্ষতা যাচাই করে দেখা হয় না। টাকা পয়সা দিলেই অনেকের লাইসেন্স হয়ে যায়।

দুর্ঘটনা ঘটার আরেকটি বড় কারণ অপ্রশস্ত দুই লেনের মহাসড়কগুলো। এ বিষয়ে সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান জানান, “এখনকার যানবাহনের আকৃতির সাথে তুলনা করলে এই দুই লেনের মহাসড়কগুলো সাব-স্ট্যান্ডার্ড হয়ে গিয়েছে। আগে এখানে ৪০ সিটের বাস চলতো, এখন বাসের আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তখন দেখা যায় চার লেনের রাস্তা বা এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যখন এই বড় যানগুলো দুই লেনের রাস্তায় ঢোকে তখন তারা আগের গতিই ধরে রাখে, কিন্তু ওই সরু সড়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।”

তদন্ত কমিটি

মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটলেও জড়িতদের উল্লেখ করার মতো কোনো শাস্তি হয়নি। শাস্তি হলেও সেটা সীমাবদ্ধ ছিল চালক ও হেলপারের মধ্যে।

কিন্তু যাদের গাফেলতিতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়নি।

এর বড় কারণ দুর্ঘটনার পর গঠন করা তদন্ত কমিটিগুলো।

সড় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হলেও সেগুলো স্বাধীন নয়, তদন্ত কমিটি করা হয়, তাতে বিআরটিএ, পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, সওজ প্রতিনিধিদের। যেখানে কিনা তারাই এই নিরাপত্তা ঘাটতির জন্য দায়ী।

কমিটিতে কোন সেফটি বিশেষজ্ঞরা থাকেন না। এ কারণে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ যেমন উঠে আসে না, তেমনি কমিটির সুপারিশও বাস্তবায়নও হয় না।

সব মিলিয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সংস্থাগুলোর নিজেদের দায় কিংবা ঘাটতি তদন্তে উঠে আসে না।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের অধ্যাপক মো. মাহবুব আলম তালুকদার বলেছেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে যদি হাইওয়ে পুলিশের সদস্য, বিটিআরসির লোক নিয়ে কমিটি হয় তাহলে কেমন তদন্ত হবে?

“বাংলাদেশে সড়ক ব্যবস্থাপনা এতো বেশি বিশৃঙ্খল, কোথাও কোন ডিসিপ্লিন নেই। এখানে আইন প্রয়োগে কমিটি করা হয়। কিন্তু কাউকে জবাবদিহিতায় আনা হয় না।” তিনি বলেন।

তার মতে, দুর্ঘটনার তদন্তে কমিটি নয়, উন্নত দেশগুলোর মতো স্বাধীন কমিশন থাকা প্রয়োজন। যেখানে বিশেষজ্ঞরা থাকবেন।

মি আলম বলেন, “এখানে ন্যাশনাল রোড সেফটি কাউন্সিল আছে। যাদের কাজ তিন মাস অন্তর মিটিং করা, নতুন আইন বা আইন সংশোধন করার কথা, কিন্তু এই সমস্যাকে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে সমাধানের ধারে কাছে কেউ নাই। মিটিং হলে তারা খোশ গল্প করে, কেউ সিরিয়াস না।”

“যারা পরিবহন নিয়ে কথা বলে তাদের কোন জ্ঞান-বুদ্ধি নাই। বিআরটিএ -এর লাইসেন্স প্রক্রিয়া ঠিক নেই। প্রশাসন কোন আইন প্রয়োগ করে না। সবাই নিজস্ব সুবিধা নিয়ে আছে। কোন সমন্বয় নেই।”

এক্ষেত্রে তিনি মহাসড়কের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে বিআরটিএর ভূমিকা কমিয়ে লাইসেন্স দেয়া, ফিটনেস পরীক্ষার মতো কাজগুলো বেসরকারিকরণের পরামর্শ দিয়েছেন।

সেইসাথে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নিরপেক্ষ মনিটরিং সেল ও তদন্ত কমিটি করা প্রয়োজন বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেছেন, “আমাদের মহাসড়কের যানবাহন আনফিট, চালক আনফিট। এক্ষেত্রে সড়কে যে হতাহত হচ্ছে এটাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে কিনা সেটা ভাবার সময় এসেছে। দুর্ঘটনা বললে পরিবেশের ওপর দোষ চাপানো হয়। কিন্তু আমাদের এখানে এমনটা হচ্ছে না। আমাদের নিজেদের গাফেলতিতে এমনটা হচ্ছে যা চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।”

নিরাপদ সড়কের জন্য ২০১৮ সালে বেশ সাড়া জাগানো আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা।

সড়কের নিরাপত্তায় শাস্তি বহু গুণ বাড়িয়ে আইন করা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়।

সরকারের দিক থেকে সড়ক নিরাপদ করতে নানা আশ্বাস দেওয়া হলেও কোনটাই ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্ঘটনাও রোধ হচ্ছে না।

আরও পড়তে পারেন

2024-04-20T05:12:31Z dg43tfdfdgfd