বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন জোগানে টাকাই বাধা বন্টন সংস্থার

কৌশিক প্রধানগরমে টানা তাপপ্রবাহে রাজ্যে বিদ্যুৎ চাহিদা সর্বকালীন রেকর্ড গড়েছে। শুক্রবার সিইএসসি ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা মিলিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল 12,663 মেগাওয়াট। এর মধ্যে বণ্টন সংস্থা এলাকায় রাত সাড়ে 11টায় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়ায় 9,935 মেগাওয়াটে, যা ঐতিহাসিক রেকর্ড। সিইএসসি এলাকায় শুক্রবার বিকেল 3টে 15-য় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল 2,728 মেগাওয়াট, যা সংস্থার ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

এক প্রশাসনিক কর্তার কথায়, ‘এখনও পর্যন্ত রাজ্যে কোথাও লোডশেডিং হয়নি। ওভারলোডিংয়ের জন্য ট্রিপ বা ফল্টের কারণে কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটেছে। তবে আবহাওয়ার যা পরিস্থিতি, তাতে এ রকম গরম চলতে থাকলে আগামী দিনগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।’

সূত্রের খবর, এই অবস্থায় রাজ্যের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উপর সর্বক্ষণ নজর রাখছেন বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। লোকসভা ভোটের প্রচার সংক্রান্ত ব্যস্ত সময়সূচির মধ্যেও তিনি প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতির রিপোর্ট নিচ্ছেন।

গত বছর 16 জুন বণ্টন সংস্থা এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা পৌঁছেছিল 9,181 মেগাওয়াটে, যা ছিল সংস্থার ইতিহাসে সর্বোচ্চ চাহিদা। আর এ বছর 26 এপ্রিলেই তা পৌঁছে গিয়েছে 9,935 মেগাওয়াটে। অর্থাৎ, 754 মেগাওয়াট বেশি। একই ভাবে সিইএসসি এলাকায় গত বছর 16 জুন বিদ্যুতের চাহিদা পৌঁছেছিল 2,606 মেগাওয়াটে, যা সংস্থার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। শুক্রবার সেই রেকর্ড ভেঙে গিয়ে নতুন চাহিদা পৌঁছেছে 2,728 মেগাওয়াটে।

হঠাৎ করে রাজ্যে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় 900 মেগাওয়াট বেড়ে গেল কেন? তা-ও আবার গরমের শুরুতেই? সিইএসসি ও বণ্টন সংস্থা, দুপক্ষেরই যুক্তি, এসি-র ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে যাওয়াই এর কারণ। দুই সংস্থারই পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অনেকে তাদের না জানিয়ে এসি ব্যবহার করার জন্য সিস্টেমে ওভারলোডিং হয়ে ট্রিপ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। এসি-র কারণে বণ্টন সংস্থা এলাকায় পিক ডিমান্ড হচ্ছে রাত 11টা থেকে 11টা 40-এর মধ্যে।

কিন্তু, এতো গেল লোড বাড়ার প্রসঙ্গ। এই হারে দীর্ঘস্থায়ী ভিত্তিতে চাহিদা বাড়লে কি তার মোকাবিলা করা সম্ভব? সিইএসসি-র এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টর (ডিস্ট্রিবিউশন) অভিজিৎ ঘোষের জবাব, ‘শুক্রবারই আমরা রেকর্ড ২,৭২৮ মেগাওয়াটের চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ করেছি। চাহিদা আরও বাড়লে আমরা তার পুরোটা সরবরাহ করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। তবে গ্রাহকদের কাছে আমাদের একটাই আর্জি এসি লাগালে আমাদের জানান। তাতে আমাদের সিস্টেমে লোড ম্যানেজমেন্ট করতে সুবিধা হয়।’

এ বছর 1 মার্চ থেকে 15 এপ্রিল পর্যন্ত কলকাতায় দেড় লক্ষের কাছাকাছি এসি বিক্রি হয়েছে। সেখানে সিইএসসি মাত্র ৩৪ হাজার এসি-র আবেদন পেয়েছে বলে সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, হাজারটি এক টনের এসিতে মোট 1 মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হয়।

তবে বিশেষজ্ঞমহলের মতে, যত দিন যাচ্ছে, বণ্টন সংস্থার পক্ষে কাজটা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। কেন? এক বিশেষজ্ঞ জানান, বণ্টন সংস্থার এখন দৈনিক চাহিদা প্রায় 10 হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে তারা পিডিসিএল থেকে পায় 4,200 মেগাওয়াট। নিজেদের ছোটখাটো হাইড্রো এবং পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ থেকে বণ্টন সংস্থা আরও 2 হাজার মেগাওয়াট পায়। বাকি চাহিদা পূরণে ভরসা এনটিপিসি, ডিভিসির মতো সেন্ট্রাল সেক্টর, স্বল্পমেয়াদী ভিত্তিতে বাইরের কোনও বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীর থেকে বিদ্যুৎ কেনা এবং সর্বোপরি বাজার থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়।

তিনি বলেন, ‘2016-য় শেষবার রাজ্যে বিদ্যুতের মাশুল বেড়েছিল। অথচ, এর মধ্যে খরচ অনেকটাই বেড়েছে। এমনকী, জ্বালানির দাম বাড়ার জন্য বণ্টন সংস্থাগুলির যে বাড়তি খরচ হয়, তা-ও তারা গ্রাহকদের থেকে নিচ্ছে না। এর ফলে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার আর্থিক অবস্থা এমনই হয়েছে যে তারা স্বল্পমেয়াদি ভিত্তিতে বাইরের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি দিতে প্রবল সমস্যায় পড়েছে।’

অন্য এক বিশেষজ্ঞ জানান, পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাকে ইউনিট প্রতি 3 টাকা 80 পয়সা পাওয়ার পারচেজ কস্ট অনুমোদন করেছে। সেই কমিশনই পিডিসিএল-কে পাওয়ার সেলিং কস্ট ইউনিট প্রতি 4 টাকা 20 পয়সা নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘অর্থাৎ, বণ্টন সংস্থা ইউনিট প্রতি 4 টাকা 20 পয়সায় বিদ্যুৎ কিনে 3 টাকা 80 পয়সায় বিক্রি করছে। ফলে, গোড়াতেই ইউনিট প্রতি 40 পয়সা লোকসান। আবার পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজে দিনে জল তুলতে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বেশি দামে কিনতে হয়। রাতে সেখান থেকে পাওয়া যায় 900 মেগাওয়াট। অর্থাৎ, বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে জল তুলে কম দামে বিদ্যুৎ বেচে বিপুল লোকসান করছে তারা।’ সর্বোপরি গত 10 বছরে পিডিসিএল রাজ্যে কোনও নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করেনি। যদিও কয়েক মাস আগে চারটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার ঘোষণা করেছে রাজ্য।

রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার মোট গ্রাহক 2.30 কোটির মতো। এর মধ্যে ৮৪ লক্ষ ‘হাসির আলো’ গ্রাহক, যাদের মাসিক খরচ 25 ইউনিট পর্যন্ত। এদের মাসে 40 কোটি টাকার মতো বিল হয়, যার পুরোটাই রাজ্য সরকার ভর্তুকি বাবদ বণ্টন সংস্থাকে দেয়। মাসে 100 ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ খরচ করেন, বণ্টন সংস্থার এমন গ্রাহক ৩০ লক্ষের মতো। ফলে, প্রবল অর্থকষ্টে থাকা বণ্টন সংস্থার কার্যত প্রাণভোমরা এই 30 লক্ষ গ্রাহকই। অর্থাৎ, এই 13 শতাংশ গ্রাহকই সংস্থাকে বেঁচে থাকার অক্সিজেন দিচ্ছে। উল্লেখ্য, 2022-23 অর্থবছরের শেষে বণ্টন সংস্থার মোট আয়ের তুলনায় 1656 কোটি টাকা খরচ বেশি হয়েছিল।

এই ধরনের আরও খবর জানতে এই সময়ে আসুন। লেটেস্ট নিউজ, শহরের তাজা খবর, দেশের খবর, ব্যবসার খবর, খেলার আপডেট, দৈনিক রাশিফল এবং লাইফস্টাইলের টিপস জানুন। আর ভিডিয়োর জন্য রয়েছে TimesXP

2024-04-29T08:08:52Z dg43tfdfdgfd