আকুল অপেক্ষায় নারীরা

বরং প্রতিটি অভ্যুত্থানের পেছনে থাকে সাধারণ মানুষের বিপুল আশা-আকাঙ্ক্ষা, যে আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের প্রত্যাশায় কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়াও তারা অভ্যুত্থান প্রক্রিয়ায় শরিক হয়৷

শরিক হতে না পারলেও মানসিক, অথবা অন্য যে কোনোরকম সহায়তা অব্যাহত রাখে৷

অতীতে বাংলাদেশের প্রতিটি অভ্যুত্থান মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছে একটি নতুন ব্যবস্থার- একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের৷ যে ব্যবস্থায় জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত হবে, যে অধিকার ও সুযোগে মানুষ তার সর্বোচ্চ কর্মশক্তি ও মেধা কাজে লাগিয়ে নিজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা তৈরি করে নিতে পারবে৷ মানুষের চাওয়া বেশি কিছু নয়৷ সে ‘স্বর্গীয়', কিংবা ইউটোপিয়ান কিছু চায় না৷ স্বাভাবিক মানব জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের নিশ্চয়তা চায়৷ কিন্তু তা কোনোভাবেই অনৈতিক, কিংবা অন্যায্যভাবে নয়৷

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রতিটি গণ-অভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরেছে,সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ কিন্তু মানুষ তার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আজও কোনো অধিকার পুরোপুরি ফিরে পায়নি, তার সুযোগ শতভাগ নিশ্চিত হয়নি৷

৫৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও একটি রাষ্ট্রের মানুষ এখনো স্থিত হতে পারেনি তার জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে,মৌলিক অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা নিয়ে৷ অথচ একের পর এক ক্ষমতার পালাবদল,গণ-অভ্যুত্থান ঘটনার ঘনঘটা আর এসব ঘটনায় জন মানুষের সংশ্লিষ্টতা ও অবদানও কম ছিল না৷

সম্প্রতি ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পরও মানুষের আশা ছিল একটা নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র৷ সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র, ন্যায় ও নীতির রাষ্ট্র৷ অধিকার ও সুযোগের রাষ্ট্র৷

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার নির্বাচিত সরকার নয়৷ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়, কিন্তু জনগণের আকাঙ্ক্ষার সরকার৷ অভ্যুত্থান-পরবর্তী ছাত্র-জনতা যাদের সরকারে চেয়েছে, তারাই সরকারে অধিষ্ঠিত হয়েছে৷ এদের ব্যাপারে কারো কোনো আপত্তি দেখা যায়নি৷ সেদিক থেকে এই সরকারকে মানুষের প্রত্যাশার সরকার বলা যেতে পারে৷ সবাই তাদেরকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছে৷ অভূতপূর্ব সমর্থন দিয়ে এদের বরণ করেছে৷ এই নিরঙ্কুশ সমর্থন, যার আসলে কোনো পরিমাপ নেই৷ কিন্তু তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা গগনচুম্বী৷ কারণ, স্মরণকালের দৃষ্টান্তমূলক গণ-অভ্যুত্থানের জনতার শক্তি তার চালিকাশক্তি৷ এই জনসমর্থন নিয়ে যে-কোনো কল্যাণমূলক সিদ্ধান্ত নেয়া ও কাজ করা সহজ৷ এদের কাছে সময়ের সবচেয়ে ইনক্লুসিভ সোসাইটি চাওয়া এবং পাওয়া সম্ভব৷

একমাস অতিক্রান্ত হয়েছে৷ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের বিষয় আজ আমার আলোচনার বিষয় নয়৷ আমি বলছি, পথে-ঘাটে নারীর অবমাননা বিষয়ক ঘটনাগুলোর কথা৷ গত একমাসে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নারীদের যেভাবে হেনস্থা করা হয়েছে তা উদ্বেগজনক৷

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়ানো কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যায় এক যুবক একটি লাঠি হাতে কয়েকজন নারীকে নির্বিচারে লাঠিপেটা করে যাচ্ছে৷ পরে জানা গেল, মেয়েগুলো যৌনকর্মী৷ ঘটনাটি ঢাকার শ্যামলী এলাকার৷

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় ককক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে এক নারীকে কান ধরে উঠবস করাচ্ছে ‘সম্মিলিত জনতা’৷ এই কার্যের উদ্যোক্তা এক যুবক, যে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে জানাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে সহায়তা করছে৷

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় এক নারীকে বেধড়ক পেটাচ্ছে এক পুরুষ৷ অফিস কক্ষের মতো একটি কক্ষ৷

এখানে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয়কে সুর্নিদিষ্ট করে আলোচনা করা যায়৷

প্রথমত, এই যে পুরুষগুলি নারীদের প্রকাশ্যে (না, মোটেই আমি বলছি না, অপ্রকাশ্য হলে পেটানো জায়েজ ছিল) নারীর গায়ে হাত তুলেছে, তারা এই সমাজেরই পুরুষ৷ এই সমাজ থেকেই এরা এই মূল্যবোধ পেয়েছে যে, নারীর গায়ে হাত তোলা যায়, তা প্রকাশ্যে হোক, কিংবা অপ্রকাশ্যে৷

দ্বিতীয়ত লক্ষণীয় যে বিষয়টি তা হলো, যে পুরুষটি পেটাচ্ছে সে যেমন নির্বিকার, ঠিক তেমন নির্বিকার আশেপাশে যারা দেখছে তারাও৷ কেউ নারীটিকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসছে না৷ এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে৷ এরা হয়তো ভয়ে এগোচ্ছে না, কিংবা মানসিকভাবে এরা কোনো নারীকে নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচানোর কোনো নৈতিক তাড়না বোধ করে না৷ কিংবা হতে পারে নীতিগতভাবে এরা এই নিপীড়ন সমর্থন করে৷

তৃতীয়ত, যারা এই কাজগুলো করেছে তাদের আচার আচরণ এবং ঔদ্ধত্যে এটা স্পষ্ট যে, তারা গর্বের সাথে একটি ‘পবিত্র' দায়িত্ব পালন করছে৷

এই সমাজে জন্ম নেয়া মূল্যবোধ ধারণ করে বড় হওয়া যে পুরুষটি আজ প্রকাশ্যে অপরিচিত নারীকে বেধড়ক পিটালো, আর যারা এর প্রতিবাদ না করে সহায়তা, সমর্থন দিলো এবং নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো, তার জন্য তারা নিজেরা কতটা দায়ী, কতটা দায়ী সমাজ-সংসার এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট? এই বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে৷

একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যে হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি, বরং এ দেশের জল-হাওয়াতেই বেড়ে উঠেছে, এই সমাজের ‘সিস্টেম' এবং শিক্ষায় মূল্যবোধ অর্জন করেছে৷ যে সিস্টেম এবং শিক্ষা তাকে শিখিয়েছে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ' করা নারীকে ‘সমুচিত শিক্ষা' দেয়াই উচিত, তা সে যেভাবেই হোক- প্রকাশ্যে পিটিয়ে কিংবা অপ্রকাশ্যে অপমান করে৷

এই শিক্ষা দেয়ার জন্য আইন নিজের হাতে তুলে নিতে সে দ্বিধা করে না৷ সে নিজের হাতে আইন তুলে নেয়াকে এবং ‘অপরাধী' নারীকে ‘উপযুক্ত শিক্ষা' দেয়া পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করে৷

তার আশেপাশে যারা দর্শক হিসাবে ঘটনাগুলো অবলোকন করছে, তাদের অধিকাংশই নৈতিক এবং মানসিক ও সামাজিকভাবে পুরুষটিকে সমর্থন করছে৷ প্রতিবাদের তো প্রশ্নই ওঠে না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহায়তা করছে৷

যে সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ এবং শিক্ষা পুরুষদের এরকম বোধে এবং মূল্যবোধে উদ্বোধিত হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছে এতকাল, সেই সমাজে ঘটনাগুলি বিচ্ছিন্নভাবে ঘটলেও বিচ্ছিন্ন বলার সুযোগ নেই৷

বরং বলা যায়, এরকম ঘটারই কথা ছিল৷ বরং প্রশ্ন হতে পারে- এতকাল ঘটেনি কেন? এখন কেন ঘটছে?

এর কারণ অনুসন্ধান জরুরি, যদি আমরা এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না চাই৷ মূলত অনুকূল পরিবেশেই অনুজীব বংশবিস্তার করে৷ চারা গাছ উপযুক্ত পানি, মাটি, সার পেলে বেড়ে উঠে, ফল দেয়,ফসল দেয়৷

তলে তলে মানুষের মানসিকতা চরমপন্থার দিকে ধাবিত হলেও উপরি কাঠামোতে কিছু রাখঢাক ছিল৷ আইন এবং বিচারের ভয় ছিল, শালীন এবং সভ্যতার দেয়াল ছিল৷

হঠাৎ করে যেন সেই ভয়ের খাঁচা ভেঙে পড়েছে৷ এবং চারপাশে যা ঘটছে, তাতে এই কাজগুলো যারা করছে, তারা বুঝতে পারছে এই ‘অপরাধ' করা মহিলাদের শায়েস্তা করতে হবে এবং এখনই তার উপযুক্ত সময়৷ এখন আইন নিজের হাতে তুলে নিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পাওয়া যাবে এবং এর কোনো বিচার হবে না৷

মূলত মেয়েগুলো যদি ‘দেহ ব্যবসায়ী' হয় এবং ‘অপরাধী’ও হয়, এর দায় মেয়েগুলোকে কতটা দেয়া যায়? সমাজের কি এতে কোনো দায় নেই?

মেয়েগুলোকে ‘শায়েস্তা’ করার আগে, ‘অপরাধী’ চিহ্নিত করার আগে আঙুল যে নিজের দিকে তোলা উচিত এই বোধ আমাদের অধিকাংশের মধ্যে নেই৷

কক্সবাজারে নিপীড়ক ছেলেটি গ্রেপ্তার হয়েছে৷ সূত্রে জানা গেছে,উপদেষ্টার ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে৷ হয়ত ছেলেটিকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে, হয়তো হবে না৷ আদতে এই ধরনের কর্মকাণ্ডের বিচারের জন্য আদৌ নির্দিষ্ট কোনো আইন আছে কিনা আমার জানা নেই৷ জানতে হবে৷ যদি থাকে, তবে মনেপ্রাণে চাইবো এর বিচার নিশ্চিত করা হোক৷ কিন্তু এই ছেলের গ্রেপ্তার একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ একজন সহানুভূতিশীল উপদেষ্টার ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফসল৷

কিন্তু নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর এ বিষয়ে আমরা তাদের সুনির্দিষ্ট, দৃঢ় এবং সময়োচিত কোনো পদক্ষেপ মোটেই দেখতে পাচ্ছি না৷ কিংবা এ নিয়ে সমন্বিত কোনো হুঁশিয়ারি বা সতর্কবার্তাও দৃশ্যমান নয়৷ ফলে যে যার মতো আইন হাতে তুলে নিচ্ছে৷ যে যার মতো যাকে-তাকে যেখানে-সেখানে শায়েস্তা করছে৷ দুই চারদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উত্তাল হচ্ছে, তারপর আবার ঝিমিয়ে পড়ছে পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায়৷

আজ এক ‘অপরাধে’ নারীকে প্রকাশ্যে অপমান করা হচ্ছে, কাল অন্য অপরাধে করা হলেও কারো কিছু করার থাকবে না৷ আর অপরাধ বিষয়টি তো স্থান-কাল- দেশ সাপেক্ষে আপেক্ষিক৷ কাজেই এই নিপীড়নকে নৈতিক সমর্থন দেয়ার ক্ষেত্রেও মানুষের অভাব হবে না৷ কঠিনভাবে এর রাশ টেনে না ধরলে আগামীর বাংলাদেশ নারীর জন্য একেবারেই নিরাপদ থাকবে না৷

বর্তমান সরকারে একাধিক উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চ মূল্যবোধসম্পন্ন নারী প্রতিনিধি আছেন৷ দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নারীরা তাদের দিকে আকুল নয়নে তাকিয়ে আছে৷ নারীর অবমাননার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই দ্রুত এবং কঠোর পদক্ষেপ তারা নেবেন৷

কোনো দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে আতঙ্কে আর অনিশ্চয়তায় ফেলে সেই দেশ কোনোভাবেই এগিয়ে যেতে পারে না৷ নারী জাতিকে নিরাপত্তা আর নিশ্চয়তা না দিলে সব শুভ এবং সংস্কারের উদ্যোগ ভেস্তে যেতে সময় লাগবে না৷

প্রতিবেদন: রুমা মোদক

2024-09-19T10:57:33Z dg43tfdfdgfd