ইন্দিরা-বিরোধী ইয়েচুরিই কংগ্রেস-জোটের কারিগর

এই সময়: ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। জরুরি অবস্থার অবসান হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের পতনও হয়েছে। কিন্তু তখনও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর পদে রয়েছেন ইন্দিরা। এই পদে কেন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন? এ প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরে সরব ছিলেন জেএনইউ-এর পড়ুয়ারা। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র সংসদের তরুণ সভাপতির নেতৃত্বে তাঁরা মিছিল করে ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনের সামনে যান।

এ হেন প্রতিবাদের মুখে বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসেন ইন্দিরাও। সেই তরুণ ছাত্রনেতা কেন চ্যান্সেলর পদ থেকে ইন্দিরার ইস্তফা দেওয়া উচিত, সেই লিখিত স্মারকলিপি পড়ে শোনান। ইন্দিরা মন দিয়ে যুক্তিগুলি শোনেন। এবং চ্যান্সেলার পদ থেকে ইস্তফা দেন।

সে দিনের সেই তরুণ নেতাই পরে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। জেএনইউ-কে বামপড়ুয়াদের দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করার নেপথ্যে প্রকাশ কারাটের সঙ্গে যাঁর বড় ভূমিকা রয়েছে। জরুরি অবস্থার সময়ে ইয়েচুরির নেতৃত্বে প্রবল ছাত্র বিক্ষোভের কারণে চ্যান্সেলর হওয়া সত্ত্বেও জেএনইউ ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেননি ইন্দিরা।

যদিও পরবর্তী সময়ে জঙ্গি নেতা নয়, একে গোপালন ভবনের অন্দরে সিপিএমের তাত্ত্বিক নেতা হিসেবেই বেড়ে উঠেছেন সীতারাম। মেঠো ভোট রাজনীতির বদলে দলের তাত্ত্বিক অবস্থান নিয়ে বিতর্কে বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাই ২০০৫ সালে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও লোকসভা ভোটে লড়ে নয়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভায় গিয়েছিলেন তিনি। বাকপটু সীতারাম রাজ্যসভায় বিরোধী শিবিরে অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

সীতারাম সিপিএমের এমন এক নেতা যিনি নিজের মাতৃভাষা তেলুগুর সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, মালয়ালমে কথা বলতে পারতেন। ১৯৫২ সালে চেন্নাইতে জন্ম। যদিও ছোটবেলা কেটেছে হায়দরাবাদে। সিবিএসসি বোর্ডের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় দেশে প্রথম হন। দিল্লির সেন্ট স্টিফেনস কলেজ থেকে অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েশন করার পর জেএনইউ-তে মাস্টার্স করতে ঢোকেন। পিএইচডি করার সময়ে ইমার্জেন্সি জারি হয় দেশে, গ্রেপ্তার হন ইয়েচুরি।

জেএনইউ-এ ছাত্র আন্দোলন করেই এসএফআই-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। এআইএসএফ ভেঙে এসএফআই তৈরি হওয়ার পরে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে কেরালা নয়, বাংলার নেতারা বসতেন। ইয়েচুরি প্রথম ছাত্র নেতা যিনি অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এসএফআই-এর সর্বোচ্চ পদাধিকারী হন।

একে গোপালন ভবনের অন্দরে ইয়েচুরি একদা কট্টর লাইনের সমর্থক ছিলেন। জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্বের বিতর্কে কট্টরপন্থা অনুসরণ করেই সিপিএমের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন ইয়েচুরি। যদিও প্রথম ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সময়ে ইয়েচুরি সেই কট্টপন্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাশে দাঁড়ান। পরে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সিপিএম-কে কট্টরপন্থার লাইন থেকে বেরও করে এনেছিলেন।

তবে এই লড়াই সহজ হয়নি। ২০১৫ সালে সিপিএমের ভাইজাগ পার্টি কংগ্রেসে ইয়েচুরি দলের সাধারণ সম্পাদক হন। দলের কট্টরপন্থী অংশ প্রকাশ কারাটের পর এসআর পিল্লাইকে ওই পদে চেয়েছিলেন। সিপিএম আড়াআড়ি ভাবে বিভাজিত হয়ে যায়। সাধারণ সম্পাদক নিয়ে ভোটাভুটির পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু কলকাতা থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপ এবং পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চে ভিএস অচ্যুতানন্দনের সক্রিয়তায় কট্টরপন্থী অংশ পিছু হটে।

ভোটাভুটি এড়িয়ে সীতারাম সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হন। তখনও ইয়েচুরি বাংলা থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সাংসদ। সিপিএমের বেঙ্গল-লবি সীতারামকে সাধারণ সম্পাদক করতেও পারলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে যে কট্টরপন্থীদের দাপট রয়েছে, তা ২০১৬ সালে টের পান সীতারাম। সে বছর বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রথম সিপিএম-কংগ্রেসের জোট হয়। তাতে ইয়েচুরির সায় ছিল কিন্তু দলের কেরালা, ত্রিপুরা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, রাজস্থানের নেতাদের প্রবল আপত্তি ছিল।

যে সীতারাম একদা ইন্দিরা গান্ধীকে জেএনইউ-এর চ্যান্সেলর পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছিলেন, সেই সীতারামই তৃণমূল এবং বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের জোরদার সওয়াল করেন। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের পর সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের লাইন খারিজ হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে সিপিএমের সেই বৈঠক কলকাতায় মুজফফর আহমেদ ভবনে হয়েছিল।

বৈঠকের পরে সীতারাম ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিপিএমের পলিটব্যুরো তাঁকেই সাধারণ সম্পাদকের কাজ চালানোর নির্দেশ দেয়।

ভাইজাগ পার্টি কংগ্রেস থেকে ২০১৮ সালের হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত সিপিএমের অন্দরে প্রবল বিতর্ক চলেছিল। বিজেপির মোকাবিলায় কেন কংগ্রেস-সহ গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা প্রয়োজন, তা নিয়ে সীতারাম রাজনৈতিক দলিল তৈরি করেন।

প্রকাশ কারাট শিবির থেকেও একটি দলিল তৈরি করা হয়। সীতারামের বিশ্লেষণ ছিল নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি ফ্যাসিবাদী শক্তি। কারাট শিবিরের বিশ্লেষণ ছিল, বিজেপি একনায়কতান্ত্রিক শক্তি। তীব্র বিতর্কের পর সীতারামের লাইন গৃহীত হয়। যে সীতারাম একদা কংগ্রেসের জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে উঠে এসেছিলেন, সেই সীতারামই কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের লাইনে নিয়ে যান সিপিএমকে।

এই সময়ে রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও সীতারামের মসৃণ সমীকরণ তৈরি হয়েছিল। যে হেতু সীতারাম সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক, তাই ঘনিষ্ঠ মহলে সীতারামকে রাহুল 'ক্যাপ্টেন' বলে ডাকতেন। সীতারাম-রাহুলের এই সমীকরণ পরবর্তী সময়ে 'ইন্ডিয়া' ব্লক তৈরির নেপথ্যে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। একদা হরকিষেণ সিং সুরজিৎ যে ভাবে বিজেপি-বিরোধী দলগুলির নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করতেন, সীতারাম গত এক দশক ধরে সে কাজ করতেন।

ইয়েচুরির এই জোটের লাইনের কারণেই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও তামিলনাড়ু, রাজস্থান, বিহার প্রভৃতি রাজ্যে বাম-কংগ্রেসের জোট হয়েছিল। জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন সিপিএমের আন্তর্জাতিক বিভাগের দায়িত্বে থাকার কারণে চিন, ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের পাশাপাশি ব্রিটেনের লেবার পার্টির একাংশের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল সীতারামের।

এই ধরনের আরও খবর জানতে এই সময়ে আসুন। লেটেস্ট নিউজ, শহরের তাজা খবর, দেশের খবর, ব্যবসার খবর, খেলার আপডেট, দৈনিক রাশিফল এবং লাইফস্টাইলের টিপস জানুন। আর ভিডিয়োর জন্য রয়েছে TimesXP

2024-09-13T06:02:31Z dg43tfdfdgfd